এই বিশ্ব পৃথিবীর সমস্ত কিছুই একে অপরের সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ । মানব সংসারের এই
বন্ধনের ভিত্তি হল স্নেহ,প্রেম ,মায়া ,মমতা।সদ্য অঙ্কুরিত চারা গাছ প্রকৃতির আলো বাতাস জলে লালিত
হয়ে পরিপুষ্ট লাভ করে ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে ওঠে, বৃক্ষে পরিণত হয়ে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে বিশাল
আকার প্রাপ্ত হয়,কিন্তু সে কখনই অস্বীকার করতে পারে না মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা তার শিকড়ের
টানটিকে । ঠিক তেমনি করেই সদ্যজাত শিশু তার মা বাবা ও পরিবারের সবার
আদরে ,যত্নে,স্নেহে,ভালবাসায়,মায়া মমতায় বড়ো হয়ে ওঠে,আস্তে আস্তে পরিচয় ঘটে বাইরের জগতের
সঙ্গে। সেই পরিবারের ছত্রছায়ায় বড়ো হয়ে ওঠা মানুষটিও কখনই অস্বীকার করতে পারে না তার
নিবিড় পারিবারিক টানটিকে । বিভিন্ন উৎসব এই পারিবারিক বন্ধন কে আরো সজ়ীব করে তোলে। আর
এই উৎসবের মাধ্যমেই প্রতিটি দেশ এক দিকে যেমন নিজেদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাচ্ছে,অপর দিকে
তেমনি একটি পারিবারিক এবং সামাজিক ঐক্য মন্ত্রের একটি সুরে বেঁধে চলেছে।
সেরকমই ভারতবর্ষ হল একটি উৎসব প্রধান দেশ।নানা
জাতীর ,নানা গোষ্ঠীর, মধ্যে পালিত হয় ছোটো বড়ো নানা
উৎসব, অনুষ্ঠান। সব উৎসবেরই মূল মন্ত্র হল মিলনের
মন্ত্র,ঐক্যের সুর।
রাখী বন্ধন হল সেই রকমই একটি পারিবারিক মিলনের
উৎসব।কিছুদিন আগেই আমরা এই উৎসবটি পালন করলাম।
শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিনে রাখী বন্ধন পালিত হয়।এই দিনে
দিদি তার ভাই এর হাতে হাতে রাখী বেঁধে দেয়।এই বন্ধনের
মধ্যে থাকে ভাই এর প্রতি দিদির আন্তরিক শুভকামনা, ভাই
এর মনে থাকে দিদি কে রক্ষা করার দায়ীত্ববোধ।এই রাখী বন্ধন
এক বন্ধন শক্তির প্রতিরূপ ,যে শক্তি সকল প্রকার বাধা বিঘ্নতা,প্রতিবন্ধকতা, কাটিয়ে ভাই বোন কে
জীবণ যুদ্ধে জয় লাভ করার নীরব শপথ করায়।
তবে এই মাঙ্গলিক উৎসবের পিছনে আছে অনেক পৌরাণিক গল্পকথা ও ঐতিহাসিক কাহিনী। তারমধ্যে
একটি হল মহাভারত থেকে।মহাভারতে কথিত আছে যে শ্রীকৃষ্ণ একবার রথের চাকার আঘাতে আহত
হয়েছিলেন,তখন দ্রৌপদী তাঁর নিজের শাড়ী ছিঁড়ে কৃষ্ণের রক্তাক্ত হাতে বেঁধে দেন।দৌপদীর এই সেবা
শ্রীকৃষ্ণ কে মোহিত করে এবং তিনি দ্রৌপদীর প্রতি এক নিবিড় স্নেহের বন্ধন অনুভব করেন।এই
ঘটনার পর থেকে শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রৌপদীর মধ্যে এক পরম শ্রদ্ধা ও স্নেহ এর বন্ধন সৃষ্টি হয়।এর পর বহু
বছর কেটে যায়। রাজা ধৃতরাষ্ট্র এর সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের গল্প আমাদের সবার জানা।সেখানে
আমরা দেখেছি যে অসম্মানিত, অপমানিত দ্রৌপদী কে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন কৃষ্ণ,তিনি তাঁর
বসন কে বর্ধিত করে দ্রৌপদী কে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করেন। অনেকের বিশ্বাস যে মহাভারতের
দ্রৌপদী আর কৃষ্ণের এই স্নেহের বন্ধনই হিন্দু সমাজে রাখী বন্ধন এর মূল সূত্র।
এই রক্ষা বন্ধন উৎসবেরই একটি ঐতিহাসিক গল্পও আছে।
মুসলমানী সাম্রাজ্য গ্রাসীত ভারতবর্ষে রাজপুত আর সুলতান দের যুদ্ধ চলাকালীন চিতরের বিধবা রাণী
কর্ণবতী বুঝেছিলেন যে গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহকে শক্তি বলে পরাজীত করার সহজ নয়।তখন
রানী কর্ণবতী দিল্লীর মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের কাছে সাহায্য প্রার্থনার্থে সম্রাট কে রাখী উপহার পাঠান।এই
উপহার সম্রাট কে মোহিত করে ও তিনি রানী কর্ণবতীর সঙ্গে স্নেহের সম্পর্কে আবদ্ধ হন এবং রাজপুত
দের সঙ্গে মিত্রতা করেন।তাই সে দিনের ছোট্টো উপহারটি যুদ্ধের হিংস্রতা কে শিথিল করতে সক্ষম
হয়েছিল।
আমরা বাঙ্গালী রা রাখী বন্ধন উৎসবটিকে একটু আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেখি।
বাংলায় রাখী বন্ধন প্রবর্তণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।আমাদের দেশ তখন বৃটিশ দের অধীনে
শাসিত।১৯০৫ সালে ২০ জুলাই ভাইসরয় লর্ড কার্জন এর সিদ্ধান্তে ঘোষিত হয় যে বাংলা কে দুই ভাগে
ভাগ করা হবে।এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার শক্তিকে খর্ব করা।ঠিক করা হয়েছিল যে হিন্দু ও মুসলিমের
প্রাধান্য অনুসারে সমগ্র বাংলাকে পূর্ব আর পশ্চিম বাংলায় বিভক্ত করা হবে।১৯০৫ সালে ১৬ অক্টবরে
এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয়।সমগ্র বাংলা এই বিভাগের প্রতিবাদে সচ্চার হয়ে ওঠে।শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ
আন্দোলন।এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এর অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তিনি বাংলার সব মানুষ কে
আহবান জানান এর প্রতিবাদে সামিল হবার জন্য।এই দিনটিতে তিনি রাখী বন্ধন উৎসব পালন করেন
বাঙ্গালীদের নিয়ে।রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত রাখী হিন্দু সমাজে প্রচলিত অনুষ্টানের থেকে তাই কিছুটা ভিন্ন।এটা
কেবল মাত্র ভাই বোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়,তিনি জাতী, ধর্ম, নির্বিশেষে সকল মানুষ কে আবহান
জানান একে অপরের হাতে হলুদ রঙের রাখী বেঁধে দিতে।এই অনুষ্ঠানের মধ্যে ধ্বনিত হয়েছিল ঐক্যের
সুর, আর বিভেদের তীব্র প্রতিবাদ।রাখী বন্ধনের মধ্য দিয়ে অসংখ্য বাঙ্গালীর মধ্যে জাগ্রত হয়েছিলো
মিলনের সুর,জাতীয়তাবোধ।কবির সঙ্গে তারা যোগদান করেছিলো প্রতিবাদী শোভাযাত্রায়।কবির রচিত
গান গেয়ে তারা বঙ্গভঙ্গ এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো......
'' বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পুন্য হউক পুন্য হউক পুন্য হউক হে ভগবান.........।।
এই ভাবে রাখী বন্ধন উৎসব বিভিন্ন রূপে একটি পারিবারিক মিলন বন্ধনের উপযুক্ত উদাহরণ সরূপ
আমাদের জীবনে,আমাদের মনে,আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। এখন বর্তমানে
আমাদের জীবনে রাখী বন্ধন উৎসব শুধুমাত্র দিদি-ভাই এর মধ্যেই পরিসীমিত নেই-দাদু-নাতনী,দিদি-
বোন,বান্ধবী-বান্ধবী এবং রাজনৈতিক জগতেও তারা নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার এবং মিলনের ঐক্য
বন্ধনের এই সুত্রটি বেঁধে নিজের সর্ম্পককে আর দৃঢ় করে তুলছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন